গর্ভবতী অবস্থায় মায়েদের যে ব্যাপক শারিরীক পরিবর্তন আসে, তা তো সবারই জানা। কিন্তু এর পাশাপাশি তার মনোজগতেও ঘটে বিপুল পরিবর্তন। শারিরীক যত্নের পাশাপাশি এই সময়ে তার মানসিক যত্নেরও প্রয়োজন। এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখতে হবে স্বামী, শ্বশুর বাড়ির লোকজন ও সহকর্মীদের। আসুন জেনে নেই, এই সময় আমরা কিভাবে তাদের সাহায্য করতে পারি।
প্রথম তিনমাসঃ এই সময়টাতেই গর্ভপাত ঘটার সম্ভাবনা বেশী থাকে। নারী এই সময়টাতে প্রাকৃতিক ভাবেই একটু প্রটেক্টিভ বা রক্ষাকারী আচরণ করতে থাকে। তার চলাফেরার মাঝে অবচেতন মনেই একধরণের সতর্ক ভাব চলে আসে। যে কোন ভারী কাজকর্ম, সিড়ি ভাঙ্গা এই সব সে এড়িয়ে যেতে চায়। তাছাড়া শারিরীক বিভিন্ন অসুবিধা যেমন মাথা ঘোরা,বমি এইসব এই সময়েই বেশী হয়।
করনীয়ঃ এই সময় টাতে শারিরীক ভাবে গর্ভবতী হওয়ার লক্ষন ফুটে না উঠাতে শশুর বাড়ির লোকজন বা স্বামীরা ভাবেন যে মেয়েটি সুস্থ্যই আছে। তখন তারা আশা করে যে, মেয়েটি এই সময়টাতে স্বাভাবিক ভাবে ঘড়ের কাজ কর্ম করবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, পরের মাসগুলোতেই সে বরং স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারবে, কিন্তু গর্ভপাতের ভয়ে অবচেতন মনের সতর্ক আচরণ তাকে এই সময় কাজ করতে বাধা দেয়। এরপর যদি বাড়ির লোকেরা বুঝতে না চেয়ে তার কাছ থেকে আগের মতই ঘরকন্নার কাজ আশা করেন, তাহলে সে স্বীকার হয় ডিপ্রেশনের। তাই এই সময়টা তাকে বিশ্রাম থাকতে দিন, পাশাপাশি সে সতর্ক ভাবে চলাফেরা করলে/করতে চাইলে তার প্রতি মনোযোগ প্রকাশ করুন। এতে তার আপনার প্রতি আস্থা ও নিরাপত্তার মনোভাব গড়ে উঠবে।
দ্বিতীয় তিন মাসঃ এ সময়ে গর্ভপাতের আশঙ্কা চলে যাওয়াতে নারী মোটামোটি স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারে। মাথা ঘোরা, বমি ভাব চলে যাওয়াতে সে মোটামোটি ঘড়ের কাজ করতে পারে/অফিস করতে পারে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে আয়নার সামনে দাড়ায়। এই সময়ে শরীরে গর্ভবতী হওয়ার লক্ষন ফুটে উঠে। তার ওজন বৃদ্ধি পায়। নিজের শারিরীক অসৌন্দর্য নিয়ে সে মনোযাতনায় ভুগে। পাশাপাশি তার স্তনের সেন্সিটিভিটি বা সংবেদনশীলতা বাড়ে, যৌনাংগ অঞ্চলে রক্ত প্রবাহ বাড়ে, ভ্যাজাইনাল ফ্লুইড (যৌন রস) ও বৃদ্ধি পায়। তাই এই সময়ে সে মিলনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কিন্তু তার সঙ্গী এখনো তার প্রতি আকর্ষন বোধ করে কিনা এই ভেবে সে সদা অনিশ্চয়তা ও বিষন্নতায় ভুগে।
করনীয়ঃ স্বামীদের উচিত এই সময়ে বেশী সময়ে স্ত্রীর পাশে থাকা। তাকে বোঝানো যে, সে এখনো তার চোখে আগের মতই সুন্দর। স্বামীর সঙ্গে এই সময় নারীর মন কিছুক্ষনের জন্য নির্ভার হলেও, হরমোনের প্রভাবে তার মুড ওঠানামা করতে পারে। কিছুক্ষন পরে সে একই অভিযোগ করে আবার কান্না শুরু করতে পারে। বেশিরভাগ পুরুষ তাই ঝগড়া-ঝাটি এড়ানোর পদ্ধতি হিসেবে, বাইরে বেশি সময় কাটান। এবং এটাই হলো তাদের করা সবচেয়ে দায়িত্বহীন পদক্ষেপ। কষ্ট হলেও, ধৈর্য্য ধরে বার বার তাকে বোঝান। অনেক পুরুষ আবার নারীর শরীরে গর্ভবস্থার প্রকট লক্ষন দেখে মিলনে বিরত থাকেন। কিন্তু যেহেতু এই সময় নারীরা মিলন কামনা করেন এবং এই সময় মিলনে গর্ভপাতের ঝুকি নেই, তাই স্ত্রী মিলিত হতে চাইলে এড়িয়ে যাবেন না। এতে তাদের মনে আবার অনিরাপত্তা বোধ এর জন্ম হবে। স্বামী ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্য, সহকর্মী, বান্ধবীরা বাচ্চা জন্মের পর শারিরীক সৌন্দর্য পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে তাকে আশস্ত করুন। যেহেতু এ সময় পুরোনো কাপর গুলো আর গায়ে লাগেনা, কাছের লোকজন তাকে নতুন কাপর-চোপড় এ উপহার দিয়ে খুশী রাখতে পারেন, । “এখন কাপড় বানিয়ে কি লাভ? বাচ্চার জন্মের পরে তো আর এসব গায়ে লাগবেনা”- এইসব বলে বেশিরভাগ স্বামী ই তাদের স্ত্রীদের বাধা দেন। আবার এ সময় নারীরা রূপচর্চায় মনোযোগী হয়ে উঠলে শশুর বাড়ির লোকজন এটাকে নেতিবাচক চোখে দেখে সমালোচনা করেন। এসব না করে তাকে পরিপাটি ও পরিষ্কার-পরিচ্চন্ন থাকতে দিন। এতে তার মন প্রফুল্ল থাকবে যা বাচ্চার জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়।
তৃতীয় তিন মাসঃ এ সময় বাচ্চার জন্মের সময় এগিয়ে এসেছে। নারী এখন সৌন্দর্য্য সচেতনতা ছেড়ে জন্ম প্রকৃয়ার প্রতি মনোযোগী হয়। জন্মের প্রকৃয়ার ভীতি, মৃত্যুভয় এবং জন্মের পর বাচ্চা লালন-পালনের কষ্টকর প্রক্রিয়ার চিন্তা তাকে কাবু করে ফেলে। পাশাপাশি অফিস থেকে মাতৃকালীন ছুটি নেয়ার ব্যাপারটা চলে আসে। এসময় ভবিষ্যত ক্যারিয়ারে তার মাতৃত্ব কি প্রভাব ফেলবে এই চিন্তা তাকে অস্থির করে তোলে।
করনীয়ঃ স্বামীরা জানতে চান সে কোন ধরণের জন্মপ্রক্রিয়ায় যেতে চায়। টাকা পয়সা জোগারের ব্যাপারে তাকে আশ্বস্ত করুন। বলুন যে তার চিকিতসায় কোন ঘাটতি থাকবে না। পরিবারের মুরব্বীরা জানান যে তারা তার জন্য দোয়া করছেন। তাতে সে কিছুটা নিরাপদ বোধ করবেন। সহকর্মীরা আশ্বস্ত করুন যে, এই সময়টা তার কাজকর্ম টুকু তারা দেখাশোনা করবেন।
গর্ভাবস্থায় স্বপ্নঃ গর্ভাবস্থায় নারী নানা রকম ভীতির মাঝে থাকেন, যার প্রতিফলন ঘটে তার স্বপ্নে। অনেকে স্বপ্ন দেখেন যে সে কোথাও বন্দী অবস্থায় আছেন। সন্তান পরবর্তী সন্তান লালন-পালনের ধৈর্য্যপূর্ণ প্রক্রিয়া অথবা সন্তান জন্মের পর কর্মজীবন কে কিভাবে সামাল দিতে হবে-এই ধরণের দুশ্চিন্তা থেকে এই স্বপ্নের উতপত্তি। অনেকে স্বপ্ন দেখেন যে সে কোন ধরণের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই সময় নারীরা তাদের ভারসাম্যহীন শরীর নিয়ে চিন্তিত থাকেন। তাদের মনে ভয় কাজ করে যে এই ভারসাম্যহীন শরীর নিয়ে সে যে কোন সময় পড়ে গিয়ে আঘাত পেতে পারেন। তা থেকেই এই ধরণের স্বপ্নের উতপত্তি। প্রথম মা হতে যাওয়া নারীদের ক্ষেত্রে এই স্বপ্ন আসলে জন্মপ্রকৃয়ার ব্যথার প্রতি ভীতি কে প্রকাশ করে। আবার অনেকে স্বপ্ন দেখেন তার বাচ্চা হারিয়ে গিয়েছে বা সে তার বাচ্চাকে খুজে বেড়াচ্ছে। এই ধরণের স্বপ্ন সাধারণত গর্ভবস্থার শেষের দিকে হয়। এই সময়টাতে মায়েরা জন্মদান প্রক্রিয়ার কথা বেশি চিন্তা করেন। সুস্থ একটা বাচ্চার জন্ম এবং নারী কাটার মাধ্যমে শরীর থেকে বাচ্চার আলাদা হয়ে যাওয়ার চিন্তার প্রতিফলন ঘটে এই স্বপ্নে।
করণীয়ঃ আপনার স্ত্রীর সাথে রোজ একান্তে কিছু সময় কাটান। জিজ্ঞেস করুন রাতে ভালো ঘুম হয়েছে কিনা। তার স্বপ্ন শুনলেই বুঝতে পারবেন যে সে ঠিক কি নিয়ে বেশী ভীত। সেইসব ব্যাপার গুলোতে তাকে নির্ভয় করতে চেষ্টা করুন। ভবিষ্যত বাচ্চা নিয়ে তার সাথে পরিকল্পনা করুন। এই সময়টাতে তার মন আনন্দে পরিপূর্ণ থাকবে। অহেতুক ভয়-ভীতি তার থেকে দূরে থাকবে।
উপরে যে মানসিক পরিবর্তন এর কথা বলা হয়েছে, তা সব নারীর ক্ষেত্রেই কম বেশী ঘটে। তবে এটি “ক্লিনিকাল বিষন্নতা” রোগ নয়, তাই এর কোন ধরণের চিকিতসার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু পরিবার ও আশেপাশের মানুষ দের ভালোবাসা। গর্ভকালীন ও গর্ভ-পরবর্তী বিষন্নতা নিয়ে পরবর্তীতে পোস্ট দেয়া হবে।