এবড়োখেবড়ো সড়কের পাশের সাদামাটা ফটক পেরিয়ে এগোলেই দৃষ্টিনন্দন দুই তলার পোশাক কারখানা ভবন। ৫৮ হাজার বর্গফুটের এই কারখানায় ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে ছিমছাম পরিবেশে কাজ করবেন ১ হাজার ২০০ শ্রমিক। ওপরের তলায় কাজ চলবে সূর্যের আলোতে। আকাশ মেঘলা থাকলে আপনাআপনি জ্বলে উঠবে বাতি।
ফটকের পাশেই বাইসাইকেলের ছাউনি, তার ওপরে এবং আরেকটি ভবনের ছাদে আছে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল। এর মাধ্যমেই চাহিদার ১৩ শতাংশ বিদ্যুৎ আসবে। কারখানা ভবন থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা হবে। বাথরুমে বসানো হয়েছে এমন ধরনের সরঞ্জাম, যা সাশ্রয় করবে পানি। সব মিলিয়ে অন্য তৈরি পোশাক কারখানার চেয়ে এখানে বিদ্যুৎ ও পানি অর্ধেক কম লাগবে।
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংপুর প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ভেতরের চিত্র এটি। ৫ দশমিক ৫০ একর জমির ওপরে গড়ে ওঠা কারখানাটি হতে যাচ্ছে দেশের তো বটেই, বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানা। আমেরিকার ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) ‘লিড’ নামে পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ দিয়ে থাকে। লিডের পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। এ সনদ পেতে একটি প্রকল্পকে নির্মাণ থেকে শুরু করে উৎপাদন পর্যন্ত সর্বোচ্চ মান রক্ষা করেত হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো করা কারখানাকে দেওয়া হয় প্লাটিনাম মর্যাদা।
প্লামি ফ্যাশনস কর্তৃপক্ষের দাবি, ইউএসজিবিসির নিয়মকানুন শুরু থেকেই মেনে চলছে প্লামি ফ্যাশনস। নকশা থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের সবকিছুই তাদের নির্দেশনায় হয়েছে। চলতি মাসের ইউএসজিবিসি প্রতিনিধিদের পরিদর্শনের শেষেই সনদটি পাওয়া যাবে। এখন পর্যন্ত প্লাটিনাম সনদ পাওয়া দেশের একমাত্র পোশাক কারখানা ঈশ্বরদী ইপিজেডের ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। এটি মূলত ডেনিম প্রস্তুতকারক হওয়ায় নিট পোশাকে এটাই হবে প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানা। তবে দেশের পোশাকশিল্পের হিসাবে এটি দ্বিতীয়।
গত শনিবার এই প্রতিবেদকসহ চার সাংবাদিককে কারখানাটি ঘুরিয়ে দেখান প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক। তাঁর সঙ্গে ছিলেন পরিচালক ফয়সাল পরাগ ও রঞ্জন কুমার ধর। দুই তলা মূল কারখানা ভবনটি ইস্পাতের (প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড বিল্ডিং) তৈরি। তিন পাশেই আছে লম্বা বারান্দা। ওঠা-নামার জন্য পাঁচটি সিঁড়ি থাকলেও বের হওয়ার দরজার সংখ্যা ১১টি। শ্রমিকেরা যাতে স্বস্তিতে কাজ করতে পারেন সে জন্য পুরো কারখানাটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। সব সময় সেখানে ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকবে।
ভবনের ওপরের তলার পুরোটাই সূর্যের আলোয় চলবে। এতে ৭০ কিলোওয়াট বিদু্যৎ সাশ্রয় হবে। আবার কোনো কারণে আলোর স্বল্পতা দেখা দিলে আপনাআপনি জ্বলে উঠবে এলইডি বাতি। এ ছাড়া পুরো ভবনে পাইপ লাগানো হয়েছে, যা দিয়ে বৃষ্টির পানি নিচের ট্যাঙ্কে জমা করা হবে। এ জন্য দুই লাখ লিটার ধারণক্ষমতার একাধিক ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে। আর এই পানি বাথরুমের পাশাপাশি অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহৃত হবে।
এ বিষয়ে আরও কিছু তথ্য দিলেন ফজলুল হক। বললেন, লিড প্লাটিনামের শর্ত হচ্ছে এমন নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করতে হবে যাতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। এ ছাড়া ইট, সিমেন্ট ও ইস্পাত পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে সেটি নিশ্চিত করতে হয়। এতে করে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়। একই সঙ্গে সব উপকরণ কারখানার সবচেয়ে কাছের প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করেছি। এতে পরিবহনের জন্য জ্বালানি কম খরচ হয়। এটিও একটি শর্ত। সব মিলিয়ে নির্মাণ উপকরণের ৯০ শতাংশই দেশিয়।
ফজলুল হক আরও বলেন, লিড প্লাটিনাম অনেক শর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে যেখানে কারখানা হবে তার ৫০০ বর্গমিটারের মধ্যে শ্রমিকদের বাসস্থান, স্কুল, বাজার, বাস বা ট্যােম্পা স্ট্যান্ড থাকতে হবে। কারণ দূরে হলেই শ্রমিকদের কারখানায় আসতে গাড়ির প্রয়োজন হবে। এতে জ্বালানি খরচের পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ হবে। সেই বিচারে এই কারখানা আশপাশে সবই আছে।
এদিকে কারখানায় বসানো হয়েছে সর্বশেষ প্রযুক্তির সেলাই মেশিন, যা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ার পাশাপাশি ধুলাবালি শোষণ করে নেবে আপনাআপনি। উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি এমনভাবে আয়োজন করা হয়েছে যে, পোশাক তৈরি থেকে শুরু করে সব প্রক্রিয়া শেষ করে সেখানেই মোড়কজাত হয়ে যাবে।
কারখানার বাইরে বিশাল জায়গা নিয়ে শ্রমিকদের জন্য লাইফস্টাইল সেন্টার করা হয়েছে। দুই তলা এই ভবনের নিচতলায় শিশুদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র ও খাবারের জন্য ডাইনিং কক্ষ থাকছে। ওপরের তলায় আছে নামাজঘর ও একটি প্রশিক্ষণ কক্ষ। এখানে একসঙ্গে ২০০ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। ভবনের ছাদে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল লাগানো হয়েছে। আর লাইফস্টাইল সেন্টারের সামনে আছে ছোট লেক ও ফোয়ারা।
ফোয়ারার আরেক পাশে আলাদা ভবনে পণ্যের গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে। ৩৩ হাজার বর্গফুটের এই আধুনিক গুদাম তিন তলাবিশিষ্ট। পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য থাকবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। গুদামের সামনেই কর্মকর্তাদের কার্যালয় ও নিটিং কারখানা। কারখানার পেছনের অংশে করা হয়েছে ডায়িং কারখানা। পাশেই আছে বর্জ্য পরিশোধনাগার বা ইটিপি। এ ছাড়া আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম। সব ভবন এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে কোনোটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে, অন্যটিতে তা ছড়াবে না। এমনটাই জানান ফয়সাল পরাগ।
গত বছরের এপ্রিলে শুরু হওয়ার পর সব অবকাঠামো নির্মাণ শেষ। বর্তমানে চলছে সাজসজ্জার কাজ। মূল কারখানা ভবনের সামনে রোপণ করা হয়েছে দেশিয় গাছ। সব মিলিয়ে কারখানার চত্বরে আছে ৫২ শতাংশ খোলা জায়গা। এই কারখানাটি নির্মাণে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৬০ কোটি টাকা। অবশ্য এর সঙ্গে জমির মূল্য যোগ হবে।
কারখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্লামি ফ্যাশনসে কর্মসংস্থান হবে দুই হাজার লোকের। মাসিক উৎপাদনক্ষমতা হচ্ছে ৯ লাখ ২০ হাজার পিস পোশাক। চলতি মাসের শেষের দিকে কারখানার উৎপাদন শুরু করবে কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন ফজলুল হক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ মাসের শেষের দিকে কারখানাটি দেখতে আসবেন একাধিক ক্রেতা। পোশাকের মূল্য কম দেওয়ার বিষয়ে ক্রেতাদের একটা খারাপ উদাহরণ আছে। আমরা তাঁদের বলব, দাম একটু বাড়িয়ে এ ধরনের কারখানাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য। না হলে দেশে তো এসব হবে না।’
বিশ্বের পোশাকশিল্পে এখন পর্যন্ত তিনটি কারখানা লিড সনদের প্লাটিনাম মর্যাদা পেয়েছে। এর দুটি শ্রীলঙ্কায়, অপরটি ভিনটেজ ডেনিম। নতুন যোগ হচ্ছে প্লামি ফ্যাশনস। এই তথ্য দিয়ে ফজলুল হক বললেন, ‘আমরা চাই দেশে এ ধরনের আরও ৫০–১০০টি পরিবেশবান্ধব কারখানা হোক। সেটি নিজেদের অর্থায়নেই করার মতো অনেক উদ্যোক্তা আছেন। তাহলেই এ শিল্পের নেতিবাচক ভাবমূর্তি দূর হবে।’
সুত্রঃ প্রথম আলো