আমরা পারস্পরিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকারক সামাজিক ব্যাধি বলতে সাধারণত শুধু
প্রকাশ্য ব্যাধিগুলোকেই বুঝি। যেমন হিংসা, লোভ, গীবত, রাগ ইত্যাদি। এগুলোকে প্রকাশ্য বললাম, কারণ আমরা এসবের ক্ষতি সম্পর্কে জানি, এগুলো নিয়ে প্রচুর আলোচনা করি এবং প্রায়ই এগুলো থেকে দূরে থাকার
চেষ্টা করি। কিন্তু কিছু কিছু দোষ বা খারাপ কাজ অনেক সময়ই আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়।
নিজের অজান্তেই আমরা কারো সাথে, এমনকি অতি প্রিয়
কোনো বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথেও এসব খারাপ কাজ করে ফেলি, যা আমাদের সম্পর্ককে খারাপ করে আর সম্পর্কের মাঝে ধরায়
অনিরাময়যোগ্য সূক্ষ ফাটল। তেমনই একটি নিন্দনীয় কাজ হলো সন্দেহ।
“সন্দেহ” শব্দটি
ছোট হলেও এই শব্দের ক্ষমতা অনেক। একটি সুন্দর সম্পর্ককে নিমেষে শেষ করে দিতে
সন্দেহের থেকে বড় অস্ত্র আর হয়না। অনেকে বলে ভালোবাসার সম্পর্কে সন্দেহ থাকা ভালো।
এতে সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত হয়। কথাটি একেবারেই ভিত্তিহীন।
আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে আমরা প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হই,
যা পারস্পরিক বিশ্বাস ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান
করতে চেষ্টা করি। এতে যদি কাজ না হয়, তাহলে যাদের নীতিবোধ কিছুটা হলেও আছে, তারা ঐ সমস্যা/বিষয় থেকে বেরিয়ে আসি। আর যাদের নীতিবোধ নেই, তারা আত্মহত্যা, খুন, এসিড ছোঁড়া ইত্যাদির
মাধ্যমে পত্রিকার পাতায় খবর হই। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখি, অনেক পারিবারিক সমস্যার পেছনে ইন্ধন যোগায় সন্দেহ নামক এই
ভয়ানক ব্যাধিটি? আমি আমার এই পোস্টে
সন্দেহের কারণ, ফলাফল ও তার প্রতিকার
নিয়ে আলোচনা করবো।
সন্দেহ কী
আপনি যখন কারো প্রতি না জেনে কোনো খারাপ ধারণা পোষণ করবেন, সেটাই সন্দেহ। যদি কারো সম্পর্কে কোনো ধারণা করতেই হয়,
তাহলে ভালো ধারণা করাই মঙ্গল। আর যদি মনে মনে
খারাপ ধারণা চলে আসে, তাহলে বলা উচিত "আমি
জানি না", যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনার
ঐ ধারণা অন্য কারো উপকারে আসবে। যেহেতু আমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী এবং আমার ধর্মে
সন্দেহ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তাই
স্বাভাবিকভাবেই এই লেখায় কিছু ইসলামিক রেফারেন্স চলে আসবে। যদি এ নিয়ে কারো আপত্তি
থাকে, তাকে অনুরোধ করবো,
যখন কোনো ইসলামিক রেফারেন্স (কুরআন, হাদিস ইত্যাদি) সামনে আসবে, জাস্ট রেফারেন্সের বক্তব্যটা পড়বেন, তারপর সেটা ভালো না খারাপ তার উপর নির্ভর করে
সমর্থন/বিরোধিতা করবেন। কারণ কোনো কথা যদি ভালো হয়, তাহলে তা কে বললেন (তাঁকে আপনি বিশ্বাস করেন বা না করেন,
সম্মান করেন বা না করেন), তা বড় না, কথাটাই বড়।
পবিত্র কুরআনের ৪৯ নম্বর সূরা আল হুজুরাতের ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,
হে ঈমানদাগণ, বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোন কোন ধারণা ও অনুমান গোনাহ৷ দোষ অন্বেষন করো না৷ আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে৷ এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে ?দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়৷ আল্লাহকে ভয় করো৷ আল্লাহ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু৷
এই আয়াতে বেশি বেশি ধারণা করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কারণ কিছু কিছু
ধারণা খারাপ ছাড়া ভালো কিছু বয়ে আনে না। এছাড়াও, ধারণা করার আগে আমাদের বুঝতে হবে, কীরূপ ধারণা ভালো আর কীরূপ ধারণা খারাপ। যুক্তি প্রমাণ ছাড়া
খারাপ ধারণা তথা সন্দেহ থেকে বিরত থাকাই উচিত। আপনি যদি কারো সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে
খারাপ কিছু না জানেন, তাহলে তার সম্পর্কে ভালো
ধারণা করাই সমীচীন। এটা শুধু ইসলামের দাবি না। এটা মানবতা তথা মনুষ্যত্বের দাবি।
আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (স)
বলেছেন (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম),
ধারণা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা ধারণা
মিথ্যা বলারই নামান্তর।
এ থেকেই বোঝা যায়, মুহাম্মাদ (স)
কুধারণা তথা সন্দেহ পোষণ করাকে কতটা নিরুত্সাহিত করেছেন।
সন্দেহের কারণ
সন্দেহ মানুষের একটা পুরান ও সহজাত বৈশিষ্ট্য। যেকোনো অজানা বা অচেনা কিছু
সম্পর্কেই আমরা ধারণা করতে পছন্দ করি। এই ধারণা ততক্ষণ পর্যন্ত খারাপ না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তা অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমরা
অনেক সময়ই বন্ধু-বান্ধবদের আড্ডায় আমাদের জ্ঞান জাহির করতে চাই এবং একারণে আমরা
অনেক সময়ই না জেনে মন্তব্য করে বসি এই ভেবে যে যাদের বলছি তারা তো আর এটা জানে না
বা ভ্যারিফাই করবে না। এর মাধ্যমে সাময়িক কিছু বাহবা বা পিঠ চাপড়ানো পেলেও আদতে
আমরা নিজেরাই যে সন্দেহের প্রশ্রয়দাতা হয়ে যাই, তা খেয়াল করি না। পরে হয়তো দেখা যায় ঐ বন্ধুদের কেউই হয়তো
আমার নামেই সন্দেহ করছে। দাম্পত্য জীবনেও, স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি অবিশ্বাস থেকেই আস্তে আস্তে জন্ম নেয় সন্দেহের।
সন্দেহের ফলাফল
শুধু সন্দেহ থেকে আমরা অনেক কিছুই করে থাকি। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, বন্ধুমহলে ফাটল ইত্যাদি অনেক কিছুর পেছনেই ইন্ধন যোগায় সন্দেহ।
অনেকেই আবার সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কারো সম্পর্কে কুত্সা রটিয়ে থাকি, যা আমাদের গীবত নামক আরেক ভয়াবহ কাজের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
আমাদের সমাজে একটা কথা প্রচলিত আছে, যা রটে তা কিছুটা বটে। এই কথার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অনেকেই নিজের গীবতকে
জাস্টিফাই করারও অপচেষ্টা চালায়। আর মানুষ তার দাবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই
অবলীলায় তার খারাপ ধারণায় তাল দেয়। এভাবেই অনেক ধারণা ডালপালা গজাতে থাকে,
যা অনেক সময় মানুষকে হিংস্রও বানিয়ে দিতে পারে
এবং এথেকে শুরু হতে পারে ফিতনা-ফাসাদের মতো আরো জঘণ্য বিষয়। আমি আমার নিজের জীবনেই
দেখেছি, আমার অনেক বন্ধু-বান্ধবের
মধ্যেই শুধুমাত্র সন্দেহের বশে অনেকদিন কথা না হওয়া বা দেখা-সাক্ষাত না হওয়ার ঘটনা
ঘটে, অথচ পরে দেখা গেছে ঐ সন্দেহ হয়তো একেবারেই
ভিত্তিহীন ছিলো। আর নিছক সন্দেহের বশে স্বামী-স্ত্রীর বিষোদগারের ঘটনা তো নিত্যই
চোখে পড়ে। এরকমও ঘটনা পাওয়া যাবে, স্বামী পরকীয়া
করছে সন্দেহে স্ত্রীও হয়তো (প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে) পরকীয়া শুরু করলো (কিংবা
উল্টোটা), কিন্তু পরে দেখা গেলো তার
সে সন্দেহ হয়তো ভুল ছিলো।
সন্দেহের প্রতিকার
একজন মুসলিমের জন্য সন্দেহবাতিকতা দূর করার জন্য উপরে উল্লিখিত কুরআনের আয়াত
আর রাসূলের (স) হাদীসই যথেষ্ট। কথা হলো, সন্দেহ দূর করার উপায় কী? (নিচের পদ্ধতিগুলো
অবশ্য সবার জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে)
সন্দেহ নামক ব্যাধি থেকে দূরে থাকা যেমন খুবই সহজ, তেমনি একই সাথে আবার খুবই কঠিন। একটু সচেতন হলেই এথেকে
বেঁচে থাকা সম্ভব, কিন্তু এই সচেতনতাটুকুর
জন্যই দরকার সন্দেহ না করার অভ্যাস গড়ে তোলা। এজন্য আমরা দৈনন্দিন জীবনে কিছু কাজ
করতে পারি, যা এরকম:
১। পারিবারিক বা বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে যার প্রতি সন্দেহ পোষণ করছেন, তার সাথে মন খুলে কথা বলেন। নিজের কথা তাকে জানান, তার কথা শোনেন। কিন্তু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে আত্মঘাতী কিছু
করে বসবেন না, যার জন্য পরে সারা জীবন
কষ্ট পেতে হতে পারে।
২। যার প্রতি মন সন্দেহের কারণে বিরূপ হবে, মনে মনে তার প্রাসঙ্গিক কোনো গুণ ভাবার চেষ্টা করেন।
৩। যদি একান্তই কোনো গুণ মনে না পড়ে, তাহলে তার সম্পর্কে আপাতত চিন্তা করাই বাদ দেন।
৪। ধরেন, কেউ আপনার সাথে খারাপ
ব্যবহার করলো। আপনি ধরে নিলেন লোকটার ব্যবহারই এমন। তা না করে বরং অন্যদের সাথে
তার ব্যবহার তুলনা করে দেখেন। যদি তার ব্যবহার ভালো হয়, তাহলে ধরে নেন সমস্যাটা আপনার আর তা সলভ করার ট্রাই করেন।
৫। যখনই কারো সম্পর্কে খারাপ কোনো ধারণা আসবে, মনকে শাসন করেন। মনকে বোঝান যে আপনি কাজটা খারাপ করছেন।
৬। কারো সম্পর্কে না জেনে কিছু বলবেন না। "আমি জানি না" বলতে শিখেন।
মনে রাখবেন, আপনার সবজান্তা হওয়ার
প্রয়াস (আরে ও তো এমন, ও তো তেমন
ইত্যাদি বলার মাধ্যমে) যেনো অন্য কারো ক্ষতি ডেকে না আনে বা মানুষকে তার বিরুদ্ধে
অযথাই বিরূপভাবাপন্ন করে না তোলে।
৭। কারো সম্পর্কে না জেনে কুধারণা পোষণ করার আগে ভেবে দেখুন, আপনার প্রতি যদি কেউ অমূলক কুধারণা পোষণ করে, আপনার কেমন লাগবে।
৮। যদি কোনো আলোচনায় সন্দেহের বশে কথা বলা হয়, সে আলোচনা পরিহার করেন। পারলে এরূপ সঙ্গও পরিহার করেন।
আসেন, আমরা সবাই সন্দেহ নামক এই
গুপ্ত ব্যাধি সম্পর্কে সচেতন হই আর এর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।
আসুন জেনে নেওয়া যাক সন্দেহ প্রবণতা দূর
করার কিছু পরামর্শ।
খোলামেলা ভাবে
কথা বলুনঃ
আপনার সঙ্গী যদি
অতিরিক্ত সন্দেহ প্রবণ হন তবে তার সাথে খোলামেলা ভাবে কথা বলুন। তার মনের অহেতুক
সন্দেহগুলো দূর করার চেষ্টা করুন। এরপর যদি সে না বুঝে তো অযথা রাগারাগি করবেন না।
এতে সমস্যা বাড়বে।
ভালবাসার
মানুষটিকে সময় দিনঃ
নিজের ভালবাসার
মানুষটির সাথে বেশী বেশী সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। যখন একে অপরের সাথে সময় কাটাবেন
তখন সন্দেহের মেঘ জমার কোন অবকাশই থাকবেনা।
নিজেকে ব্যস্ত
রাখুনঃ
কথায় আছে অলস
মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তাই নিজেকে যথাসম্ভব ব্যস্ত রাখুন।আপনি অলস আছেন বলে
হয়তো ভালবাসার মানুষটিকে নিয়েই ভেবে যাচ্ছেন। কিন্তু যাকে নিয়ে ভাবছেন সে হয়তোবা
আপনাকে সেভাবে সময় দিতে পারছেনা। এমন অবস্থায় মনে সন্দেহের মেঘ জমতে পারে। তাই
নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
নিজেকে ঠিক
প্রমাণ করতে গিয়ে ভুল করে বসবেন নাঃ
সন্দেহ প্রবণ
সঙ্গীর কাছে সবসময় নিজেকে ভালো বা সঠিক প্রমাণ করতে গিয়ে অযথা ভুল করবেন না। এতে
করে আপনার সঙ্গীর সন্দেহ হতে পারে অযথাই।
বিশ্বাস করুনঃ
আপনি যখনি আপনার
সঙ্গী অথবা ভালোবাসার মানুষটিকে মন থেকে বিশ্বাস করবেন দেখবেন এসব সন্দেহের কালিমা
আপনার ধারে কাছেও আসবেনা। তাই একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখুন।
সমস্যার মূলে
যাওয়ার চেষ্টা করুনঃ
কেনো দুজনের
মধ্যে এতো ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে সে কারণ খোঁজার চেষ্টা করুন। অনেক সময় একে অপরের
প্রতি বিরক্তি,রাগ,অভিমান
ইত্যাদি কারণেও সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
অহেতুক
সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন থেকে বিরত থাকুনঃ
যখনই বুঝবেন
যাকে আপনি আগামী জীবনে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করতে যাচ্ছেন সে অতিশয় সন্দেহপ্রবণ, সেই
মুহূর্তও থেকে তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। এতে করে আগামী দিনগুলোতে ঝামেলা
পোহাতে হবে না।
সন্দেহ প্রবণতা
একটি সুখী সম্পর্কে ভাঙন ধরিয়ে দিতে পারে খুব সহজে। তাই এই সন্দেহ নামক বিষ থেকে
যতো দূরে থাকা যায় ততোই ভালো। যদি আপনার মনে নিজের সঙ্গীকে নিয়ে কোনো প্রকার অমূলক
সন্দেহ থেকে থাকে তবে তা আজই দূর করুন।
No comments:
Post a Comment
Note: Only a member of this blog may post a comment.