বাসের ভেতর চুপচাপ দাড়িয়ে আছি। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকার কারন আছে,সবকিছুরই একটা কারন থাকে! পিচ্চি হেলপারটা ভাড়া চাচ্ছিল পেসেঞ্জারদের কাছ থেকে। ওকে দেখেই ভীড়ের মধ্যে স্ট্যাচু হয়ে আছি। আমার সামনের জনের কাছ থেকে ভাড়া নিয়েই আমার কাছে আসল পিচ্চিটা। কিছুটা খোচা দিয়েই আমাকে বলল -ভাই ভাড়াটা দেন -কি? -শোনেন নাই? ভাড়াটা দেন -আমার কাছে তো টাকা নাই! -ফাইজলামি করেন? -আরে! ফাইজলামি করলাম কখন! -বাসে উঠছেন ভাড়া দিতে হইব জানেন না? এতটুকু পিচ্চি কথায় ভালই এক্সপার্ট হয়েছে! অবশ্য এক্সপার্ট হওয়ারই কথা হেলপারি করতে করতে ট্রেনিং হয়ে গেছে তার! -ভাড়া দিতে হবে তা তো জানি কিন্তু টাকা থাকবে না সেটা তো জানতাম না। -মশকরা করেন? ঘটনায় আপেক্ষিকতায় আশেপাশের পেসেঞ্জার গুলো মনযোগ দিয়ে দেখছে! একজন পেসেঞ্জার ভীড় ঠেলে এগিয়ে এসে হেলপার পিচ্চিকে বলল -কি হইছে? এতো চিল্লাচিল্লি করস কেন? -ভাই দেহেন তো এই লোকের কাছে ভাড়া চাইতাছি কিন্তু উনি ভাড়া দেয় না কয় তার কাছে নাকি টাকা নাই! শুনছেন কথাডা? তাইলে সে ভাড়া ছাড়া বাসে উঠল কেন?
পেসেঞ্জার লোকটা এগিয়ে এসে আমাকে দেখে চমকে গেল। -শুভ ভাই আপনি! -আপনি? ঠিক চিনছি না! -ভাই আমি রাসেল,কতদিন ধরে আপনাকে খুঁজতাছি। আপনার দেওয়া টাকাতেই তো ওইদিন আমার বোনের জন্য ওষুধ গুলো কিনতে পারছি! -ওহ আচ্ছা এবার চিনেছি! আপনার বোন কেমন আছে এখন? -আল্লাহর রহমতে সে এখন সুস্থ আছে ভাই। এতক্ষণে গেনজাম দেখা উৎসাহী পেসেঞ্জারদের চোখ আমার দিকে চলে এসেছে! রাসেল নামের ছেলেটা এইবার পিচ্চি হেলপার কে বলল -ওই তোর ভাড়া কত? -১৬ টাকা -আচ্ছা আমি দিতাছি দাড়া.. পকেট থেকে ১৬ টাকা বের করে পিচ্চি হেলপারটার হাতে ধরিয়ে দিল রাসেল। বাস থামল। আমি নামলাম সাথে রাসেল ছেলেটাও নামল আমার সাথে। সামনেই এক শরবত ওয়ালা কে দেখা গেল! এই গরমে এক গ্লাস লেবুর শরবত খাওয়া মন্দ নয়! কিন্তু পকেটে টাকা না থাকাটা মন্দ বলাই চলে! -ভাই শরবত খাবেন? রাসেলের মুখে কথাটা শুনে কিছুটা খুশি হলাম! কিছু কিছু মানুষ আছে যারা মানুষের মনের কথা ধরতে পারে,রাসেল ও হয়ত তাদের একজন! আমারও খুব ইচ্ছা হচ্ছিল শরবত খেতে। -হ্যা খাব। তিন গ্লাস তিন গ্লাস করে লেবুর শরবত নিয়ে দুইজনে খেলাম। বিল টা রাসেলই দিল। আমার কাছে টাকা থাকলে আমিই দিতাম। -ভাই এখানে কি কোন কাজে আসছেন? -কাজেই আসছিলাম কিন্তু কাজটা মনে হয় এখন আর দরকার নেই। -এখন কোথায় যাবেন? -আপাতত এখানেই ঘুরাঘুরি করব।
-এই রোদের মধ্যে ঘুরাঘুরি? চলেন ভাই কোন ছায়ার নিচে যেয়ে বসি। -তোমার কি কোন কাজ ছিল? -ছিল তবে আপনার থেকে আমার কাজ বেশি বড় না। ছেলেটার আন্তরিকতা প্রসংশনীয়। তবে বেশি আন্তরিক হওয়া উচিত নয়। সবকিছুই মাপমত। চা'তে চিনি বেশি দিলে চা ভাল লাগে না। চিনি দিতে হয় মাপ মত। চা এর নাম নিতেই এক চাওয়ালাকে দেখা গেল। -মামা চা লাগব? -আইস টি হবে? -এইটা কি জিনিস মামা? -আইস টি মানে শীতল চা! -মামা আমার চা তো শীতল হয়নাই এখনও গরম ধোয়া উঠতাছে ফ্লাক্সে! তয় আপনে নিয়া ঠান্ডা কইরা খাইতে পারেন। রাসেল ছেলাটা হাসছে! হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে! একবারে ছোট বাচ্চাদের মত। -না এভাবে হবে না। আমার শীতল চা চাই। -তাইলে আর কি করার!আমার কাছে হইব না মামা। কিছুটা মনখারাপ হয়েই চাওয়ালা টা চলে গেল। আমি বসেই আছি পাসে আছে রাসেল। -বুঝলে রাসেল? চিন্তা করছি আমিও চা বেচব! নরমাল চা না আইস টি..গরমে সবাই চা এর মজাও পাবে ঠান্ডাও হবে। কেমন হবে ব্যবসা টা? -খুব ভাল হবে! সুন্দর একটা আইডিয়া! রাসেল নামের ছেলেরা সবসময় সবকিছুতেই সহমত হয়। এরা কোন কারন খোজে না। ছেলেটার প্রত্যেক টা ব্যাপারই আমার কাছে সন্তুষ্ট লেগেছে। এতো সন্তুষ্ট হওয়া ভাল না। সবকিছুরই নেগেটিভ পজিটিভ দিক থাকা উচিত। রাসেল ছেলেটাকে বিদায় দিলাম। যাওয়ার আগে আমাকে কিছু টাকা দিতে চাইল..আমি নেইনি। ছেলেটা অনেক জোড় করল আমার পকেটে টাকা নাই তাই। ও হয়ত জানেই না টাকা ছাড়া চলার মত অভ্যাস আমার আছে।
শার্টের বোতাম একটা খুললাম। গরম এর মাত্রাটা অসহনীয়। -ভাই কিছু সাহায্য করেন? -কি সাহায্য করতে পারি বলুন? -কিছু টাকা দেন। -কত টাকা? -দশ পাচ টাকা যা খুশি আপনার -কি করবেন টাকা দিয়ে? -খামু -কি খাবেন? ফকিরটা কিছুটা বিব্রতই হল... -কি আবার ভাত খামু..দিলে দেন না দিলে রাস্তা মাপেন। ফকির টা আমাকে রাস্তা মাপতে বলল কেন ঠিক বুঝলাম না। রাস্তা মাপা তো মন্ত্রণালয়ে কাজ। কত মাইল পাকা রাস্তা কত মাইল কাঁচা রাস্তা বাংলাদেশে আছে তা মেপে মোট সড়কের দৈর্ঘ্যের ফলাফল জানানো তো তাদেরই কাজ। যাকগে ফকিরটা হয়ত বুঝতে পারেনি। -আমার কাছে টাকা নাই একটা তেলাপোকা আছে নিবেন? ফকির টা আমার চোখের দিকে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকাল। নানীর কাছে শুনেছিলাম ফকির অসহায় রা যদি চোখে চোখ রেখে একদৃষ্টিতে তাকায় তাহলে নাকি ধনসম্পদ কমে যায়! আমার তো ধনসম্পদই নাই কমে যাওয়া পরের ব্যাপার! ভালই হল পকেটে হাত দিয়ে তেলাপোকাটাকে পেলাম। বেচারা পকেটের ভেতর চাপ খেয়ে দম বন্ধ হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওর আর চিকিৎসার দরকার নেই। তেলাপোকা মরলেও লাখ টাকা বাচলেও লাখ টাকা।
ক্ষিদে পেয়েছে এখন খাওয়া উচিত। রোদের প্রভাব কিছুটা কমে গেছে। ভাল দেখে এক হোটেলে ঢুকে পড়লাম। টেবিলে বসতে না বসতেই এক হোটেলবয় হাজির! -কি খাইবেন ওস্তাদ? -কি আছে? -ভাতের সাথে ডাল,ভর্তা,ডিম,ভাজি রই মাছ,বোয়াল মাছ,ইলিশ মাছ,গরু, খাসী,মুরগী,তেহারি, খিচুড়ি, বিরিয়ানি। -আচ্ছা ভাত দাও সাথে ডাল ভর্তা রুই মাছ ডিম। খাওয়ার ব্যাপারে নো কিপ্টামি। যা ভাল লাগবে তাই খাওয়া উচিত...হাত ধুয়ে নিয়ে বসলাম। একে একে খাবারও আসতে লাগল। হোটেলবয় টা আমার টেবিলের সাথে লেগে আছে। একটুও নড়ছে না। অর্ধেক অর্ধেক করে সবই খাওয়া প্রায় শেষ। বিল না দেওয়ার একটা বুদ্ধি মাথায় ঘুরছিল। তেলাপোকা টাকে ডালের বাটির মধ্যে চুবালে কেমন হয়? কিন্তু হোটেলবয় টা পাশেই থাকার কারণে তা আর করতে পারছি না। হঠাৎই ছেলেটা আরেক টেবিলে গেল..এই সুযোগ! পকেট থেকে তেলাপোকা টাকে বের করে ডালের বাটিতে চুবিয়ে দিলাম। ডাল বাদে অন্য কিছু খেয়ে নিলাম আয়েস করে। আশেপাশে হোটেলবয় কে না পেয়ে ডাকা শুরু করলাম। ওই ছেলেটা এসে হাজির। -তোমাদের এই হোটেলে কি তেলাপোকার কোন আইটেম আছে? -না ওস্তাদ এইটা কি কন তেলাপোকা কি খাওয়া যায়! -তাহলে ডাল তেলাপোকার এই আইটেম আসল কিভাবে! ডালের বাটিটা আংগুল দিয়ে দেখালাম হোটেলবয় কে। হোটেলবয় ডালের বাটেটার দিকে চেয়ে দেখল একটা তেলাপোকা ভাসছে সেখানে হতভম্ব হয়ে অপেক্ষা না করেই ডাল টা চেন্জ করতে নিয়ে যেতে চাইল আমি যেতে দিলাম না। হোটেলের ক্যাশিয়ার কেও ডালের বাটি টা দেখালাম বেচারা খুব ভয় পেয়েছে। ক্যাশিয়ার কে বললাম যা খেয়েছি খেয়েছিই আর বিল চাইবেন না। অসাস্থ্যকর খাবার পরিবেশনের জন্য আপনাকে জরিমানা দিতে হবে তাহলে।
ক্যাশিয়ারের ভয়ে অবস্থা খারাপ। ক্যাশিয়ার বেচারার অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছিল। বিল না দিয়ে বিদায় হলাম হোটেল থেকে। কখনো হাতে টাকা হলে বিল টা পাঠিয়ে দিব হোটেলে.... দুপুর হয়ত তিনটার মত হবে। রাস্তার পাশে একটা পার্ক দেখতে পেলাম। ওইখানে যেয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম! একটা গুতোঁ খেয়েই নড়েচড়ে উঠলাম। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে! পাশে একটা লোক বসা। সেই আমাকে গুতোটা মেরেছে! লোকটাকে দেখে তেমন সুবিধার মনে হল না হয়ত মলম পার্টির কোন লোক। -ভাই দেইখা তো ভদ্রলোক মনে হইতাছে তা এইখানে কেন শুয়ে আছেন? এইটা তো ভালা যায়গা না। -ওহ! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! -হ তাই তো দেখলাম। এইখানে ভদ্র মানুষরা তো ঘুমায় না। এখানে আসে হিরুইনচি মদারু গাজারু রা। -আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি ভদ্র?আমিও তো হিরুইনচি হতে পারি! -ভাই এইটা কোন কথা কইলেন? মলম সামাদ কখনো মানুষ চিনতে ভুল করে না।
-হাহাহা আপনার নামটা সুন্দর তো! আনকমন নাম। -থ্যাঙ্কু ভাই..এইভাবে কেউ আমার নামের প্রশংসা করে নাই। -আপনি কি মলম পার্টির সদস্য? -আচ্ছা ভাই আগে বলেন আপনি কোন ডিবি পুলিশ টুলিশ না তো? -না আমি কোন পুলিশ নই! -যাক গা সিওর হইয়া গেলাম। আপনার বাড়ী কই ভাই? -আমার বাড়ী নাই। আত্নীয়ের বাড়ীতে থাকি। -পকেটে টাকা ছাড়া চলেন কেমনে? এক পয়সাও তো নাই পকেটে ! -আপনি আমার পকেট ও দেখেছেন? -হ অভ্যাস হইয়া গেছে চান্স পাইলেই পকেটে হাত দেই সবার। আগে ছিলাম পকেটমার এখন আরেক গ্রুপের সদস্য। -মলম গ্রুপ? -হ.. -কেমন চলে এই ব্যবসা? -চলে কোনরকম সাপ্তহের তিনদিন থাকি বাইরে চারদিন থাকি জেলে.. তবে জেলে নিয়া আমারে বেশিক্ষণ রাখতে পারে না। পুলিশের সাথে আমাদের বাইট্টা মিলন ভাইয়ের খুব মিল। ছাড়া পাই সাথে সাথেই। কিন্তু পুলিশের দৌড়ানি খাইতেই হয়... -হুম খুব কঠিন জীবন! -একটুও কঠিন না। টাকা পয়সা কামাই ফুর্তি করি খাই জীবন কাটতাছে। সুখেই আছি। মলম সামাদের কথা শেষ হতে না হতেই দৌড় দিল একটা! এক দৌড়েই হাওয়া! পুলিশের গতিবিধি হয়ত নজরে পড়েছে! লোকটার দৃষ্টিক্ষমতা ভাল। আমি উঠলাম। অন্ধকার পরে গেছে চারদিকে স্যান্ডেল টা আর দেখছি না। বড় মামা স্যান্ডেল টা কিনে দিয়েছিল নতুন স্যান্ডেল। মলম সামাদ আসার আগে হয়ত কোন ছ্যাচড়া চোর স্যান্ডেলটা নিয়ে কেটে পড়েছে! সবাই শুধু সবার ধান্ধায় থাকে... আমার কোন ধান্ধা নেই....আমার কাজ শুধু ঘুরাঘুরি করা.... কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। ইনসেনদের মত হাটতে শুরু করলাম। দেখি এই হাঁটার শেষ কোথায় হয়।
লেখাঃ Jahid Hasan