Friday, April 17, 2015

হিজড়া সম্প্রদায় : তাদের প্রতি চাই সহানুভূতিশীল আচরণ

দৈহিকভাবে পুরুষও নয়, নারীও নয়, এমন ধরনের লিঙ্গগত প্রতিবন্ধীকে হিজড়া বলা হয়। হিজড়ারা একা না থেকে সংঘবদ্ধভাবে থাকতে পছন্দ করার কারণে সমাজে হিজড়া সম্প্রদায় বলে একটি আলাদা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। এই সম্প্রদায়ের লোকদের বিয়ে, গায়ে হলুদ, শিশুর নাম রাখার অনুষ্ঠান, আকিকা, খতনা প্রভৃতি সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে নাচ-গান করে বকশিশ গ্রহণ এবং দোকানপাট থেকে সাহায্য-সহায়তা থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে জীবন নির্বাহ করতে দেখা যায়। নিজ নিজ পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র-সমাজের সব ক্ষেত্রেই হিজড়ারা নিদারুণ বৈষম্যের শিকার।

অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই হিজড়ারা তাদের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করে এবং সমাজের মূলধারা হিসেবেই বিবেচিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হিজড়াদের পরিবারের সদস্যরাও তাদের পরিচয় দিতে চান না। উত্তরাধিকার বা সম্পত্তির অধিকারে রয়েছে নানা আইনগত প্রতিবন্ধকতা ও বঞ্চনার অসংখ্য কাহিনী। অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর তারা ভোটের অধিকার পেয়েছে। তবে দেশে সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন হিজড়া জনগোষ্ঠীকে এখনও স্পর্শ করতে পারেনি। সরকারের বয়স্কভাতা কার্যক্রমেও নেই বয়স্ক হিজড়ারা। অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মতো তাদের জন্য এখনও পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোটা ব্যবস্থা।

হিজড়ারা ভিন্ন কোনো গ্রহ থেকে আসেনি। তারা আমাদেরই কারও না কারও পরিবারের সদস্য, কারও ভাইবোন বা কারও পুত্র-কন্যা। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, আমরা তাদের শুধু পরিবার থেকেই বিতাড়িত করেছি তা-ই নয়, বরং সমাজচ্যুত করেও ছেড়েছি। এমনকি তাদের পরিচয়টুকু আমরা দেই না। তারা আমাদের সব হয়েও কিছুই না। এমন অবহেলা ও মানসিকতা শুধু অমানবিকই নয়, পরিপূর্ণভাবে অনৈসলামিক। অথচ পরিস্থিতি বিবেচনায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে তাদের যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ ও স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমরা তা করি না বলেই সভ্য সমাজ থেকে একপ্রকার নির্বাসিত হয়ে হিজড়ারা বিকৃত মানসিকতা নিয়ে গড়ে ওঠে। পেটের তাগিদে জড়িয়ে পড়ে নানারকম অপরাধমূলক কার্যক্রমে। অথচ নূ্যনতম ‘মানুষ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে হিজড়াদের সামাজিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে পারলে তারাও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারতেন।

এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, হিজড়ারা মানুষের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সাধারণ মানুষও সাধ্যমতো হিজড়াদের সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু হাল সময়ে সহায়তা প্রার্থনার নামে হিজড়াদের উপদ্রব চাঁদাবাজির আকার ধারণ করেছে। আগে বিনয়ের সঙ্গে বকশিশ চাইলেও এখন যেন পাওনাদার হিসেবে টাকা পাবে এমন ভঙ্গিতে রুক্ষ মেজাজে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দাবি করছে, যা রীতিমতো চাঁদাবাজির শামিল। তাদের দাবিমতে চাঁদা না দিলে বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানায় এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে, যাতে মান-সম্মান বলতে কিছুই থাকে না। তারা বিশেষ সাংকেতিক কায়দায় হাততালি দিয়ে শব্দ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়ে এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। যারা একবার তাদের পাল্লায় পড়েছে তেমন ভুক্তভোগী মাত্রই তাদের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ার বিষয় ভালো বলতে পারবেন। হিজড়াদের চঁাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে কেউ বাধা দিলে কিংবা প্রতিবাদ করলে সংঘবদ্ধ হিজড়াদের দ্বারা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার, এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে।
তবে আমাদের এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, হিজড়ারা মানুষ, তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাদের পুনর্বাসন করা সরকারের কর্তব্য। দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, বিকলাঙ্গ, পঙ্গু, কর্মক্ষমতাহীন অসহায়দের পুনর্বাসনের জন্য সরকার কাজ করলেও লিঙ্গগত প্রতিবন্ধী তথা হিজড়া, যারা দৈহিক দিক থেকে কর্মক্ষম হওয়ার পরও তাদের কর্মে নিয়োগের মাধ্যমে পুনর্বাসনের বিষয়ে সরকার ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। হিজড়াদের মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য মোটিভেশনের মাধ্যমে তাদের কাজে নিয়োজিত করে স্বনির্ভর হওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে। হিজড়ারা যাতে সমাজের বোঝা না হয়ে কর্মগুণে সমাজ উন্নয়নে শরিক হতে পারে, সে বিষয়ে প্রণোদনা দেওয়ার লক্ষ্যে যাবতীয় কুসংস্কার পরিহার করে তাদেরকে কর্মে নিয়োগ করার বিষয়টি নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। হিজড়াদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া গার্মেন্টশিল্প, হস্তশিল্প ও কুটির শিল্পজাত প্রতিষ্ঠানেও তাদের নিয়োগ করা যেতে পারে।

সৃষ্টি রহস্যের পরিপ্রেক্ষিতে যারা বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে বা পরে রোগ বা দুর্ঘটনায় বিকলাঙ্গ হয়েছে, তেমন দৈহিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি লিঙ্গগত প্রতিবন্ধী হিজড়ারাও আমাদের এই সমাজেরই অংশ। তাই তাদের বিষয়ে সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি সমাজের বিবেকবান প্রতিটি নাগরিকেরও দায়িত্ব রয়েছে। হিজড়ারা দৈহিকভাবে কর্মক্ষম হয়েও কোনো কাজ না করে মানবিক সাহায্যের নামে অনৈতিক পন্থায় বছরের পর বছর চাঁদাবাজি করে জীবন নির্বাহ করবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। পেশাদার ভিক্ষাবৃত্তি যেমন অনৈতিক মন্দ কাজ, তেমনি হিজড়াদের চাঁদাবাজিও নিন্দনীয়। বিষয়টি সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবং সমাজসচেতন সবাইকে ভেবে দেখার অনুরোধ রইল।

শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলাম সব মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। ইসলাম হিজড়াদের ওপর কোনো অবিচার করেনি। ইসলাম মনে করে, অন্য সব মানুষের মতো হিজড়াও একজন মানুষ। সে পুরুষ হলে পুরুষের, নারী হলে নারীর বিধান মেনে চলবে। তারা উত্তরাধিকার সম্পত্তিরও অধিকারী হবে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে তাদের কোনোভাবেই বঞ্চিত করা যাবে না। এমনকি ইসলাম হিজড়াদের বিয়ে-শাদির অধিকারও দিয়েছে। একজন নারীর যেমন নামাজ, রোজা ও পর্দাসহ ইসলামের সব বিধান মানতে হয়, একজন নারী হিজড়াকেও এগুলো মেনে চলতে হয়। এভাবে পুরুষের মতো পুরুষ হিজড়াকেও। মৃত সাধারণ মানুষের মতো তাদেরও কাফন, দাফন ও জানাজা দিয়ে কবর দেওয়ার হুকুম। তবে অঙ্গহানির মাধ্যমে কোনো সুস্থ মানুষকে হিজড়ায় রূপান্তর করা নাজায়েজ ও কবিরা গোনাহ। এটা মারাত্মক অপরাধের শামিল। একজন সুস্থ মানুষের অঙ্গহানি করে অসুস্থ বানানো, সমাজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা অমার্জনীয় অপরাধ। যারা এমন দুষ্কর্ম করে তাদের কঠোর হস্তে দমন করা উচিত। ইসলামী চিন্তাবিদরা এ বিষয়ে সচেতন হতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.



Contact Form

Name

Email *

Message *