Monday, March 30, 2015

মৌসুমি ফল তরমুজ : একটি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ

একটি চমত্কার স্বাদের মৌসুমি ফলের নাম তরমুজ। অনেকে আবার তরবুজও বলে থাকেন। পানিতে ভরা থাকে বলেই হয়তো এই ফলটির ইংরেজি নাম Watermelon। তরমুজ বা তরবুজ কোন দেশের আদি ফল বা এর আদি উত্স নিয়ে অনেক গবেষণা আছে। কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গেছে, তরমুজ দক্ষিণ আফ্রিকার ফল। তবে বর্তমানে তরমুজ বাংলাদেশের নিজস্ব মৌসুমি ফলে পরিণত হয়ে গেছে। 

তরমুজের ভালো ফলন হয় বা তরমুজ বেশি জন্মে চরাঞ্চল এবং নদী সংলগ্ন চরের বেলে মাটি বা পলি মাটিতে। তরমুজ ভালো উত্পাদনের জন্য শুকনো আবহাওয়া এবং প্রচুর রোদ প্রয়োজন হয়। 

চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের সর্বত্রই তরমুজ পাওয়া যায়। তবে তরমুজের বেশি চাষ হয় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও যশোর জেলায়। এক সময় চট্টগ্রামের পতেঙ্গা তরমুজের জন্য বিখ্যাত ছিল। দেশজুড়ে পতেঙ্গার তরমুজের আলাদা একটা খ্যাতি ছিল।


তরমুজের বিভিন্ন প্রজাতি আছে। তার মধ্যে হাল্কা সবুজ, সাদা দাগবিশিষ্ট ও গাঢ় সবুজ রঙের তরমুজ প্রধান এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ায় এই দুই ধরনের তরমুজের চাষাবাদও বেশি হয়।

তরমুজ বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি ফল। ক্যালেন্ডারের হিসাব অনুযায়ী মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এই তিন মাসে বাজারে প্রচুর পরিমাণে তরমুজ পাওয়া যায়। 

দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মজাদার এই ফলটির ঔষধি গুণ সম্পর্কে আমরা অনেকে জানি না। তরমুজের বহু ধরনের ঔষধি গুণের মধ্যে কয়েকটি নিম্নে তুলে ধরা হলো :

(ক) তরমুজে প্রচুর পরিমাণ লাইকোপিন পাওয়া যায়। লাইকোপিন হচ্ছে একটি লাল বর্ণ, হরিদ্রাবর্ণ রঞ্জক বিশেষ, যা টমেটো এবং বীজশূন্য ক্ষুদ্র রসালো ফলে এবং অন্যান্য ফলে পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মানব শরীরের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং উপকারী লাইকোপিন গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি ফল তরমুজে টমেটোর চেয়ে চল্লিশ গুণ বেশি। 

লাইকোপিনের কাজ কী? 

মানুষের শরীরে ফ্রি-র্যাডিকেলস বা এক ধরনের মুক্ত রাসায়নিক কণা উত্পন্ন হয়, যা ত্বকের ঔজ্জ্বল্য নষ্ট করে দেয় এবং শরীরের চামড়ায় ভাঁজ ফেলে দেয়। ফলে অল্প বয়সেই মানুষকে বৃদ্ধ মনে হয়। এই মুক্ত রাসায়নিক কণা মানব শরীরে বিভিন্ন ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ তৈরিতে সাহায্য করে। লাইকোপিন নামক এই রঞ্জক মানব শরীরে নানাভাবে উত্পন্ন ফ্রি-র্যাডিকেলস বা মুক্ত রাসায়নিক কণাগুলো ধ্বংস করে দেয়। ফলে নানাবিধ শারীরিক জটিলতা ও রোগ থেকে মানুষ রক্ষা পায়।

লাইকোপিন বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক। লাইকোপিন রক্ত থেকে প্রস্টেট স্পেসিফিক এন্টিজেন কমিয়ে দেয়। ফলে প্রস্টেট বৃদ্ধি ও প্রস্টেট ক্যান্সারের সম্ভাবনা কমে যায়। গবেষণায় দেখা যায় যে, প্রায় ৬০ শতাংশ প্রস্টেট ক্যান্সার লাইকোপিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব। এছাড়া লাইকোপিন ফুসফুস, পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, মুখগহ্বর, রেক্টাম, শরীরের চামড়াসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে থাকে। বিশেষ করে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ নানাবিধ জটিলতার প্রায় ৮০ শতাংশই লাইকোপিনের মাধ্যমে প্রতিরোধ সম্ভব। ফিনল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, লাইকোপিন হৃিপণ্ডের রক্তবাহী নালীতে চর্বি জমতে দেয় না, এর ফলে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমে যায়। চোখের অন্ধত্ব নিবারণেও লাইকোপিন গুরুত্বপূর্ণ। 

মহিলাদের জন্য তরমুজ আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মেডিসিন। তরমুজের উপাদান লাইকোপিন মহিলাদের স্তন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, গর্ভকালীন বিভিন্ন জটিলতা বিশেষ করে খিঁচুনি থেকে রক্ষা করে থাকে। যাদের শরীরের রক্তে লাইকোপিনের পরিমাণ বেশি তারা অন্যদের চেয়ে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য ও নীরোগ জীবন যাপন করে থাকেন।

(খ) লাইকোপিন ছাড়াও তরমুজে প্রচুর পরিমাণ শর্করা, প্রোটিন, কার্বো হাইড্রেড, পানি, প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-সি ইত্যাদি পাওয়া যায়। অত্যধিক শারীরিক পরিশ্রমের কারণে যারা ক্লান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়েন, তাদের জন্য তরমুজের শরবত খুবই উপকারী। তরমুজের শরবত পরিশ্রমজনিত ক্লান্তি ও দুর্বলতা কাটায়।
(গ) ঘন ঘন পিপাসা রোধে তরমুজ অধিক কার্যকরী। যাদের ঘন ঘন পিপাসা পায়, বিশেষ করে হৃদরোগের কারণে ঘন ঘন ও অধিক পিপাসা নিবারণে কিছুদিন তরমুজের শরবত পান করলে ভালো উপকার পাওয়া যায়। 
(ঘ) তরমুজের শরবত টাইপয়েড জ্বরের তীব্রতা কমাতে এবং জ্বর পরবর্তী অস্থিরতা ও ক্লান্তি দূর করে। 
(ঙ) যারা রোদে কাজ করেন, বিভিন্ন কারণে রোদে সময় কাটাতে হয়, যাদের রৌদ্রের তাপজনিত ডিহাইড্রেশন হয়, তা কাটাতে তরমুজের শরবত বেশ ফলপ্রদ। 
(চ) পুরষের বন্ধ্যত্ব ঘোচাতে এবং কামভাব তৈরিতে তরমুজের বীজ বেশ উপকারী। তরমুজের বীজ খোসা ছড়িয়ে বেটে পানির সঙ্গে মিশিয়ে শরবত বানিয়ে পান করলে শুক্রবৃদ্ধি হয় এবং কামভাব জাগে। 

সতর্কতা



  • পাকা তরমুজ চিনবেন যে ভাবে—পাকা তরমুজ হাতে তুলে নিলে সাইজের তুলনায় অধিক ভারী অনুভূত হবে এবং নাকের কাছে নিলে এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাবে।
  • তরমুজ যদিওবা রোদে ভালো জন্মে, তবে পাকা তরমুজ সর্বদা ঠাণ্ডা স্থানে রাখা উত্তম। গরমে, তাপে তরমুজের উপাদান আয়রন নষ্ট হয়ে যায়। তরমুজ কেটে বেশিক্ষণ রাখা ঠিক নয়। তাতে তরমুজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভিটামিন-সি নষ্ট হয়ে যায়। 
  • তাই বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারসহ যারা ফুসফুসের নানাবিধ জটিলতা, মহিলাদের বিভিন্ন উপসর্গ, শরীরিক দুর্বলতা ইত্যাদি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমি ফল তরমুজ কতটা উপকারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
  • এক কথায় বলা যায়, নানাবিধ রোগ প্রতিরোধে আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালীন ফল তরমুজ আল্লাহপাকের দেয়া এক বিরাট নেয়ামত, প্রাকৃতিক মেডিসিন। 

তরমুজের ১০ উপকারিতা

বহু পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ তরমুজ। কাঠফাটা গরমে তরমুজের বিকল্প ফলের তালিকাটা তেমন দীর্ঘ নয়। ভিটামিন এ, সি, বি২, বি৬, ই ও ভিটামিন সি, কি নেই এ ফলটিতে! আরও আছে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বিটা ক্যারোটিন, লাইকোপিনসহ নানা উপাদান। স্বল্প ক্যালোরিযুক্ত এ ফলটি আপনার ওজনকেও রাখবে নিয়ন্ত্রণে। তরমুজের ১০টি পুষ্টিগুণ এখানে উল্লেখ করা হলো:




১) তরমুজ হার্টের জন্য ভালো। রক্তবাহী ধমনীকে নমনীয় ও শীতল রাখে এটি। স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখে এ ফলটি।
২) কিডনির জন্য বেশ উপকারি ফল তরমুজ। ডাবের পানির যে গুণাগুণ, তরমুজেও রয়েছে সেই গুণাগুণ। কিডনি ও মুত্রথলিকে বর্জ্যমুক্ত করে ফলটি। কিডনিতে পাথর হলে, চিকিৎসকরা ডাবের পানি, তরমুজ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। 
৩) নয়াদিল্লিতে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তরমুজ পুরুষত্বকে আরও বৃদ্ধি করে।
৪) রোগাক্রান্ত কোন ব্যক্তিকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে ভূমিকা রাখে তরমুজ। 
৫) ভাইরাসজনিত সংক্রমণ বা চোখের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা প্রতিরোধ করে এ ফলটি। 
৬) তরমুজে আছে ভিটামিন সি, যা আপনার ত্বককে সজীব রাখার পাশাপাশি ত্বকের যে কোন সমস্যা প্রতিরোধ করে। 
৭) পানিশূন্যতা জাতীয় সমস্যা প্রতিরোধ করে তরমুজ। 
৮) ভিটামিন এ এবং সি’র চাহিদা পূরণ করে এ ফলটি। ১০০ গ্রাম তরমুজ আপনার আপনার শরীরের ভিটামিন এ’র মোট চাহিদার ১১ শতাংশ পূরণ করে। আর মাত্র এক টুকরো তরমুজ প্রতিদিনের ভিটামিন সি এর চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করে। 
৯) তরমুজ রক্তচাপ কমায় ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তরমুজে পটাসিশয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকায়, তা রক্তচাপ কমায়। 
১০) লাইকোপিনসহ বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ তরমুজ খাওয়ার অভ্যাসে বার্ধক্য দেরিতে আসে। ত্বকে সহজে ভাঁজ বা বলিরেখা পড়ে না।


শীর্ষ পাঁচটি তরমুজ উৎপাদনকারী 
  1.   চীন ৭০,০০০,০০০  টন
  2.   তুরস্ক ৪,০৪৪,১৮৪  টন
  3.   ইরান ৩,৮০০,০০০  টন
  4.   ব্রাজিল ২,০৭৯,৫৪৭  টন
  5.   মিশর ১,৮৭৪,৭১০  টন
  6.   ভারত 95,211,432  টন

তরমুজ প্রাকৃতিক ভায়াগ্রা

কৃত্রিম পন্থায় যৌনশক্তি বাড়াতে ভায়াগ্রা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার অন্ত নেই। এই নীল ট্যাবলেটটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়েও অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা শেষ পর্যন্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন প্রাকৃতিক ভায়াগ্রার সন্ধান দিলেন। এই নিরীহ প্রাকৃতিক জিনিসটি আর কিছু নয়, আমাদের অতি পরিচিত তরমুজ। বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, ভায়াগ্রার মতোই কার্যকর হচ্ছে তরমুজ।

টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির গবেষক বিনু পাতিল মিডিয়াকে জানান, নতুন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা যৌনশক্তির দিক থেকে অক্ষম বা দুর্বল, তাদের সক্ষমতার জন্য তরমুজই প্রাকৃতিক প্রতিষেধক। অর্থাৎ তাদেরকে এখন থেকে আর ভায়াগ্রার পেছনে টাকা না ফেলে তরমুজ বন্দনায় মেতে উঠলেই চলবে।

বিনু পাতিল তার সহকর্মীদের নিয়ে গবেষণার পর বিস্ময়করভাবে দেখতে পান যে, একটি তরমুজে সিট্রোলিন নামের অ্যামাইনো অ্যাসিডের পরিমাণ এতো বেশি যে, যা আগে বিজ্ঞানীরা ধারণাও করতে পারেননি। কারণ বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, সিট্রোলিন সাধারণত ফলের অখাদ্য অংশেই বেশি থাকে।

বিনু পাতিল বলেন, ‘‘তরমুজে সিট্রোলিন আছে, এটা আমাদের জানা কথা। কিন্তু এটা জানতাম না যে, সিট্রোলিনের পরিমাণ তাতে এতো বেশি থাকতে পারে।’’

গবেষকরা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, মানবদেহ সিট্রোলিনকে আরজিনিনিন নামের যৌগ পদার্থে রূপান্তরিত করে। আরজিনিনিন হচ্ছে ভিন্ন মাত্রার অ্যামাইনো অ্যাসিড, যা নাইট্রিক অ্যাসিডের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে। আবার নাইট্রিক অ্যাসিড দেহের রক্তবাহী শিরা বা ধমনীর প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর রক্তবাহী শিরা বা ধমনীর প্রসারণের কারণেই মানুষের বিশেষ অঙ্গটি সক্রিয় হয়। আর ভায়াগ্রাও দেহের নাইট্রিক অ্যাসিডকে সক্রিয় করার মাধ্যমে কৃত্রিম পন্থায় দেহে জৈবিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

গবেষক বিনু পাতিল আশা করছেন, তরমুজের ভায়াগ্রা-গুণটি নিয়ে বিশ্বের গবেষকরা এগিয়ে আসবেন।

তবে তার এই গবেষণার ফলকে সবাই এক বাক্যে এখনো মেনে নেননি। ‘দি জার্নাল অব সেক্সুয়াল মেডিসিন’-এর প্রধান সম্পাদক ইরউয়িন গোল্ডস্টেইন বলেন, ‘‘বিশেষ অঙ্গের উত্তেজনার জন্য অবশ্যই নাইট্রিক অ্যাসিড দরকার। কিন্তু বেশি করে তরমুজ খেলেই তা প্রাকৃতিকভাবেই একই কাজটি করে দেবে, এটা এখনো প্রমাণিত নয়।’’

অবশ্য বিনু পাতিল এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি, জৈবিক তাড়না সৃষ্টি করতে একজন অক্ষম লোককে ঠিক কত পরিমাণ তরমুজ গিলতে হবে।





No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.



Contact Form

Name

Email *

Message *